ঘাটাইলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৬ শিক্ষার্থীর বিয়ে






ঘাটাইল : পুতুল খেলার বয়সে ওরা স্বামীর সংসারে





 

Global New News Desk   - 

গ্রামের নাম বগা। পাহাড়ের কোলঘেঁষা গ্রামটির আয়তন প্রায় দুই কিলোমিটার।ওই গ্রামে আব্দুল কুদ্দুস নামে সাত জনের বাস। ঘণ্টাদুই খোঁজাখুঁজির পর

গোধূলিলগ্নে এসে কাঙ্খিত কুদ্দুসের (৪৮) সঙ্গে দেখা। সহজ-সরল মনের মানুষ।ভ্যান চালক। স্ত্রী, দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার চলে টেনেটুনে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন আট মাস আগে। মেয়ের কথা আসতেই, প্রায় দুই মিনিট কথা বন্ধ। চোখের কোণে জমা জল গড়িয়ে পড়তে দিলেন না কুদ্দুস। কাঁধে থাকা গামছা দিয়ে চোখ মুছে জানালেন, অনেক ছোট বয়সে তিনি মা’কে হারিয়েছেন। মায়ের আদর দিয়ে বড়বোন তাকে মানুষ করেছেন। বোনের চাওয়া, ভাইয়ের মেয়েকে ছেলের বউ করে ঘরে নিবেন। মায়ের আদর আর ভালোবাসা যে বোনের কাছে থেকে পেয়েছেন, সেই বোনের আবদার নাকি ফেলতে পারেননি তিনি। কম বয়সি মেয়ে, তাই বিয়ের রেজিস্টেশন করা হয়না। স্থানীয় মসজিদের ইমাম ডেকে বিয়ে পড়ানোর কাজ শেষ করেন। বধূবেসে মেয়ে যায় স্বামীর ঘরে। এ যেন বসন্তের কোকিল ডাকার আগেই কাক ডেকে উঠল। পুতুল খেলার বয়সের মেয়েটি স্বামীর সংসারে দু’মাসও টিকতে পারেনি। নানা জটিলতায় ফিরে এসেছে বাবার ঘরে। মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল! কুদ্দুসের চোখে ফের জল। এ জল অনুতপ্তের। স্বামীর ঘরে আর নয়, মেয়ে আবার যাবে স্কুলে। তার মতো এমন ভুল করতে মানা করলেন অন্যদের।জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতায় দাদা তার নাতীর কাছে স্ত্রীর কথা বর্ণনা করেছেন, ‘এতটুকু তারে এনেছিনু ঘরে সোনার মতন মুখ, পুতুলের বিয়ে ভেঙ্গে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক’। আধুনিক এ যুগে এসেও কবির সেই বাল্যবধূর দেখা।
শিক্ষায় প্রাথমিকের গন্ডি ওরা কেউ পার হতে পারেনি। তবে বধূসেজে এলাকার গন্ডি পার হয়ে আজ স্বামীর ঘরে। সদ্য উড়া শেখা পাখির ছানাটি যেন খাঁচায় বন্দি হলো।

 

 

করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার প্রাথমিকের ১৬ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। উপজেলায় মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭২ টি। প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীর বিয়ে! এ নিয়ে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে এসব তথ্য। তাদের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির ৩ জন এবং পঞ্চম শ্রেণির ১৩ জনের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পিঁড়িতে বসা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে কথা ও এলাকাবাসি জানায়, দারিদ্রতা, শিক্ষার অভাব, আত্মীয়স্বজনসহ আশেপাশের মানুষের চাপেই বিয়েগুলো হয়েছে।একইসঙ্গে মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়েও কথা তোলেন তারা। বাল্যবিয়ের শিকার সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকরা জানান, বিয়ে হলেও কেউ কেউ আবার স্কুলে আসতেছে। নাম প্রকশে অনিচ্ছুক একজন প্রধান শিক্ষক বলেন, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বিয়ের শিকার হয়েছে। তবে আগের তুলনায় বিয়ে দেওয়ার হার অনেকটাই কমে এসেছে। ঘাটাইল উপজেলায় স্কুল বন্ধকালিন সময়ে বাল্যবিয়ে বন্ধে কোনো কাউন্সেলিং লক্ষ্য করা যায়নি। তবে টাঙ্গাইল জেলা মহিলাবিষয়ক উপ-পরিচালক মেহেরুন্নেছা মনি বলেন, করোনাকালে এ বিষয়ে আমাদের শুধু ভার্চুয়াল সভা হয়েছে, উঠান বৈঠক করা সম্ভব হয়নি। এ সংক্রান্ত ওপরের কোনো নির্দেশনা ছিলনা। স্কুল কলেজ খোলার পর আমরা জানতে পারলাম কি সর্বনাশ হয়ে গেছে! মাঠে গিয়ে আমরা নতুন করে আবার কাজ শুরু করছি। নবম-দশম শ্রেণির যে সকল শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে, এরই মধ্যে তারা অনেকেই গর্ভবতী হয়ে গেছে।ঘাটাইলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বহু শিক্ষার্থী।এখানে মাধ্যমিক স্তরে স্কুল ও মাদ্রাসার সংখ্যা ৯২ টি।  উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায় , এ পর্যন্ত ৪৫ প্রতিষ্ঠান বাল্যবিয়ের তথ্য দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে ১৩০ জন শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে।

 

 

কিন্তু সমকালে অনুসন্ধানে জানা যায়, এক স্কুলেই বিয়ে হয়েছে ৫৫ জন ছাত্রীর। তবে ওই প্রতিষ্ঠান প্রধানের দাবি সব ক্লাসের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি, এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।দেশে বাল্যবিয়ের অভিশাপ ঘোচাতে নিরন্তর প্রচেষ্টা আজও চলছে সমান্তরালে। সমাজের পুরনো এই ব্যাধি কোনোভাবেই যেন নির্মূল হচ্ছে না। শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরেই শুধু শিক্ষার্থীরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে না, প্রাথমিকের গন্ডির ভেতরেও ঘটছে এমন ঘটনা।

 

২০১৯ সালে সমকালের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল ঘাটাইলে বাল্যবিয়ের চিত্র। সেই সময় মাধ্যমিক স্তরে ৮ মাসে ৫০৬ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিল। এ নিয়ে সমকালের সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং পরের দিন সম্পাদকীয়তেও লেখা হয়। এদিকে কোভিডের শুরুতে কিছু বেসরকারি সংস্থা বাল্যবিবাহের ওপর জরিপ চালিয়েছিল।

 

গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবরে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, ২১ জেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬ টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। অর্থ্যাৎ মাসে প্রায় ১ হাজার ৯৮৩ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন।

অন্যদিকে জাতীয় সংসদের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য চাইলে তারা জানায়, গত বছরের মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৬৪ জেলায় চার মাসে ২৩১ টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পালিত হবে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস।

 

এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তাই বাল্যবিবাহরোধে কোনো কিছু করা যায়নি। স্কুল খোলার পর এসব বিষয় জানা যাচ্ছে।

ঘাটাইলের ইউএনও মো.সোহাগ হোসেন বলেন, বাল্যবিবাহরোধে অভিভাবকদের সচেতন

করা হবে। যে মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েছে ,প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ