দক্ষিণ গাযা উপত্যাকায় রাফা এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলা



প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা লড়াইয়ে ফিলিস্তিনি এলাকায় এ পর্যন্ত ১৩৯ জন নিহত হয়েছে। ইসরায়েলে নিহত হয়েছে নয় জন


Global New News Desk -

ইসরায়েল গাযায় এমন একটি ভবন বিমান হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে - যাতে আল-জাজিরা টিভি ও এপি'র মত বিদেশি সংবাদমাধ্যমের অফিস ছিল।


ইসরায়েলি বিমান হামলায় বহুতল ভবনটি ধসে পড়ে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এতে বেশকিছু অফিস ও আবাসিক ফ্ল্যাট ছিল।


আক্রমণের আগে ওই ভবনের মালিকের কাছে আগাম সতর্কবাণী দেয় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। বলা হয়, জালা টাওয়ার নামে বহুতল ভবনটিতে আক্রমণ চালানো হবে।


ভবন খালি করার জন্য মাত্র এক ঘন্টা সময় দেয়া হয়। অতিরিক্ত ১০ মিনিট চেয়ে একজনইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বার বার অনুরোধ করেন মালিক জাওয়াদ মেহেদি -কিন্তু কর্মকর্তাটি তা প্রত্যাখ্যান করেন।



এর পর ভবনটি থেকে সব লোকজনকে বের করে নেয়া হয়। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কেউ হতাহত হবার খবর পাওয়া যায়নি।



আল-জাজিরার সংবাদদাতা সাফওয়াত আল-কাহলুত বলেন, তারা এই ভবনটি থেকে বহু অনুষ্ঠান প্রচার করেছেন। কিন্তু মাত্র দুই সেকেণ্ডে এটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে।


তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এক টুইট বার্তায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা নিশ্চিত করে জানিয়েছে যে ওই ভবনটিতে তাদের ভাষায় "হামাসের সামরিক সম্পদ" ছিল এবং ওই ভবনের বাসিন্দাদের "মানব-ঢাল" হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।



ভবনটি ধ্বংসের দৃশ্য সরাসরি প্রচার করে আল-জাজিরা। তাদের উপস্থাপক আবেগপূর্ণ ভাষায় বলেন, 'তাদের চ্যানেলকে চুপ করানো যাবেনা।'


বার্তা সংস্থা এপি-র প্রধান নির্বাহী গ্যারি প্রুইট এক বার্তায় বলেছেন, এ আক্রমণে তারা স্তম্ভিত এবং আতংকিত হয়েছেন।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ইয়েন সাকি এক বার্তায় বলেছেন, এ নিয়ে ইসরায়েলের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং সাংবাদিক ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের বলা হয়েছে।


গাযায় ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং ফিলিস্তিনি হামাস গোষ্ঠীর পাল্টা রকেট নিক্ষেপ আজও অব্যাহত ছিল।



শনিবার সবশেষ খবরে গাযায় অন্তত ১৩ জন নিহত হবার কথা জানা যায়, এছাড়া বেশ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছে বলেও জানা গেছে।নিহতদের মধ্যে ১০ জন ছিল একটি যৌথ পরিবারের, এবং ৮ জন ছিল শিশু।


এর আগে কর্মকর্তারা বলেন, গাযায় একটি শরণার্থী শিবিরের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলায় দুটি পরিবারের সাত জন নিহত হয়েছে।


বলা হয়, ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকা পড়া পাঁচ মাস বয়সী একটি শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, এবং সে ছাড়া ওই পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই।


ইসরায়েলি বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণের জবাবে ফিলিস্তিনি হামাস গোষ্ঠী দক্ষিণ ইসরায়েলে আরো অন্তত ২০০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে।রকেটের আঘাতে তেলআবিব শহরের রামাত গান উপশহরে এক ব্যক্তি নিহত হয়।ইসরায়েলের বিরশেবা শহরে গাযা থেকে নিক্ষিপ্ত ফিলিস্তিনি রকেট হামলায় আহত ১৯ জনকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।বিরশেবা ও এ্যাশদদ এই দুই শহরেই বেশ কিছু ভবনের ওপর রকেট আঘাত হেনেছে।


প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা লড়াইয়ে ফিলিস্তিনি এলাকায় এ পর্যন্ত ১৩৯ জন নিহত হয়েছে। ইসরায়েলে নিহত হয়েছে নয় জন।



গত সোমবার থেকে এই সংঘাতের কারণে গাযার বাসিন্দা প্রায় ১০,০০০ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন।


গত ছ'দিন ধরে চলতে থাকা ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংঘাত থামানোর চেষ্টায় একজন মার্কিন দূত হাদি আমর ইসরায়েল সফরে এসেছেন।এই সফরের সময় তিনি ইসরায়েলি, ফিলিস্তিনি ও জাতিসংঘে কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করবেন।


শনিবার দিনটি হচ্ছে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনির ঘরবাড়ি হারানোর বার্ষিকী - এবং এ দিনটি ফিলিস্তিনিরা 'আল-নাকবা' বা মহাবিপর্যয়ের দিন হিসেবে স্মরণ করেন।



গত কিছু দিন ধরে ফিলিস্তিনি প্রাণহানি হচ্ছিল মূলত গাযায় কিন্তু শুক্রবার পশ্চিম তীরেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে ফিলিস্তিনিদের সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হন।


ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ইসরায়েল-বিরোধী বিক্ষোভ,


ওদিকে করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ অমান্য করে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিক্ষোভ হয়েছে।বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনের পতাকা বহন করেন এবং ইসরায়েল-বিরোধী স্লোগান দেন।তারা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলাকে সমর্থনের অভিযোগ করেন।


লন্ডনেও ইসরায়েলি দূতাবাস লক্ষ্য করে মিছিলে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেন।


স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের কেন্দ্রস্থলে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করেন। জার্মানির বার্লিন শহরেও বিক্ষোভ হয়েছে।


সোমবার জেরুসালেমে আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ঢুকে ইসরায়েলি পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটে তিনশরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত হওয়ার পর গাযা ভূখণ্ড থেকে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েল দিকে রকেট ছোঁড়া শুরু করে।


বদলা নিতে ইসরায়েল গাযায় বিমান হামলা শুরু করেছে, এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে কমপক্ষে ২৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে - যার মধ্যে রয়েছে নয়টি শিশু।


ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গাযা থেকে ছোঁড়া রকেটে দক্ষিণাঞ্চলীয় আশকেলন শহরের দুটো বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আহত হয়েছে ২০ জনের মত।



উল্লেখযোগ্য যে ২০১৪ সালের পরে এই প্রথম গাযা থেকে জেরুসালেমকে লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়া হয়েছে। কয়েকটি রকেট শহরের উপকণ্ঠে এসে পড়ে - যদিও হতাহতের কোনো খবর নেই।


জেরুসালেমের সাংবাদিক হরিন্দর মিশ্র বলছেন, গত সাত বছরের মধ্যে সোমবার প্রথম জেরুসালেমে জনগণকে সতর্ক করতে কয়েকবার সাইরেন বেজেছে।


"জেরুসালেম শহরের পরিস্থিতি থমথমে। শহরের পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মোড়ে মোড়ে এবং স্পর্শকাতর প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর বাইরে প্রচুর পুলিশ। অনেক বছর পর জেরুসালেমে এরকম টান টান উত্তেজনা।“



জেরুসালেম লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়ার ঘটনাকে ইসরায়েল খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিনইয়মিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস “রেড লাইন“ অতিক্রম করেছে এবং এর শাস্তি তাদের পেতে হবে। পরপরই শুরু হয় গাযায় ইসরায়েলি বোমা হামলা।


ইসরায়েলি বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পাঁচ হাজার রিজার্ভ সৈন্য মোতায়েনের এক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।


যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাতিসংঘ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নতুন দফা এই সংঘাত ও রক্তপাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মধ্যস্থতার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।


গাযায় নির্ভরযোগ্য ফিলিস্তিনি সূত্র উদ্ধৃত করে রয়টার্স বার্তা সংস্থা জানিয়েছে মিশর এবং জাতিসংঘের পক্ষ থেকে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে।


হঠাৎ এই সংঘাত কেন?


কিন্তু কোভিড প্যানডেমিকের মধ্যে নতুন করে এই লড়াই-সহিংসতা বাঁধলো কেন?


বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা জেরেমি বোওয়েন বলছেন দশকের পর দশক ধরে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধর মূলে যেসব কারণ সেগুলোর কোনো সমাধান এতদিনেও হয়নি বলেই ঘুরে ফিরে এই সংঘাত বাঁধে।


তিনি বলেন, “এবারের সংঘাতের কেন্দ্রে জেরুসালেম। রমজানের সময় পুলিশের বাড়াবাড়ি এবং আদালতের মাধ্যমে কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে উৎখাতের বিতর্কিত একটি তৎপরতা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন দফার এই বিরোধ ... তবে অন্য কোনো কারণেও এটি শুরু হতে পারতো।“


মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ফিলিস্তিনের ভুখন্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম। আর এর সূচনা হয়েছিল ১০০ বছর আগের এক ঘোষণা দিয়ে - যা পরবর্তীকালে পরিচিতি পায় 'ব্যালফুর ডিক্লারেশন' নামে।


আজকের ব্রিটেনের পাঠ্যবইয়ে আর্থার ব্যালফুরের নাম প্রায় উল্লেখ নেই বললেই চলে । কিন্তু ইসরায়েলী বা ফিলিস্তিনী ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলে তাদের অনেকেই দু-চার কথা বলতে পারবে তার সম্পর্কে।


কারণ ১৯১৭ সালের নভেম্বরের ২ তারিখ ব্রিটেনের এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা মধ্যপ্রাচ্যের ওই অঞ্চলটির ইতিহাসের মোড় বদলে দেয়।বলা যায়, সেখান থেকেই আরব-ইসরায়েল সংঘাতের সূচনা।


এই ব্যালফুর ঘোষণার মধ্যে দিয়েই প্রথম ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।


ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল একটি চিঠিতে - যা তিনি দিয়েছিলেন জায়নবাদের একজন বড় প্রবক্তা লর্ড ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে। জায়নবাদীদের দাবি ছিল ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডন নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত জায়গাটি ইহুদিদের ঐতিহাসিক বাসভূমি, এবং এখানে ইহুদিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দিতে হবে।


ব্যালফুরের চিঠিতে মাত্র ৬৭ শব্দের একটি অংশে বলা হয়, ব্রিটিশ সরকার ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র গঠন সমর্থন করে। তবে একই সাথে বলা হয়: সেখানে অ-ইহুদি যে জনগোষ্ঠী এখন আছে তাদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়।


ব্যালফুরের ঘোষণার ভাষা ইচ্ছাকৃত ভাবেই অস্পষ্ট রাখা হয়েছিল


তবে ফিলিস্তিনিরা মনে করেন এর মধ্যে দিয়েই ইসরায়েলের সাথে তাদের সংঘাতের সূচনা। এর মধ্যে দিয়েই ইহুদি অভিবাসীদের ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের পথ তৈরি হয়।


ফিলিস্তিনিরা মনে করেন, এটা ছিল এক বিরাট প্রতারণা, বিশেষ করে যখন ব্রিটেনের অন্য আরেকটি প্রতিশ্রুতিতে অটোমান শাসনাধীন আরবদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থনের কথাও বলা হয়েছিল।


আরবরা মনে করেছিল এই এলাকার মধ্যে প্যালেস্টাইনও থাকবে কিন্তু এতে সুনির্দিষ্টভাবে এরকম কিছু বলা হয় নি।


প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং প্যালেস্টাইন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্রিটেন। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই ছিল আরব, তবে ইহুদিদের সংখ্যাও বাড়ছিল।



আর্থার ব্যালফুর ১৯২৫ সালে জেরুসালেম সফর করেন ,


শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। ব্যালফুর ঘোষণাকে তার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবেই দেখা হয়, কারণ এটা ছিল ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অংশ যা তখন লিগ অব নেশন্সে অনুমোদিত হয়েছিল।


আর্থার ব্যালফুর ১৯২৫ সালে ফিলিস্তিন সফর করেছিলেন। তখন ইহুদি অধিবাসীরা তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়েছিল।


পশ্চিম তীরের রামাল্লায় একটি ফিলিস্তিনি স্কুলে একজন শিক্ষক যখন ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলেন, "তোমরা মনে করো যে ব্রিটেন ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একটি অপরাধ করেছে?"


সবাই হাত তুললো। একটি ছাত্রী বললো: "হ্যাঁ, এ ঘোষণা অবৈধ ছিল কারণ ফিলিস্তিন তখনো অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল না।আরবরা ৯০ শতাংশ হলেও ব্রিটেন মনে করে তারা সংখ্যালঘু।"


অন্যদিকে ইসরায়েলীরা ব্যালফুর ঘোষণাকে দেখে ইতিবাচকভাবে। উত্তর ইসরায়েলের একটি গ্রামের নামও দেয়া হয়েছে ব্যালফুরিয়া।


ওই ঘোষণার শতবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ সরকার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।


এতে ক্ষুব্ধ ব্রিটেনের বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভের কর্মসুচি নিয়েছে। তারা দাবি করছে, ব্রিটেনকে ব্যালফুর ঘোষণার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।


ফিলিস্তিনি শিক্ষামন্ত্রী সাবরি সাইদাম বলছেন, ফিলিস্তিনিরা এখনো তাদের নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চায় - এই 'টু-স্টেট' পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্খন পেয়েছে।"এখন ফিলিস্তিনের স্বাধীন হওয়ার এবং প্রতিশ্রুতি পূরণের সময় এসেছে" - বলেন তিনি।


হারাম আল-শরিফ কেন এত স্পর্শকাতর একটি স্থান ?


পূর্ব জেরুসালেমে কিছুদিন আগে সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছিল হারাম আল-শরিফে ঢোকার পথে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ মেটাল-ডিটেক্টর সহ নিরাপত্তা জোরদার করায় - যা ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। একে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ-সহিংসতায় তিনজন ফিলিস্তিনি ও তিনজন ইসরায়েলি নিহত হয়। আহত হন আরো অনেকে।


কারণ এই জায়গাটি ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি - এই তিন ধর্মের কাছেই পবিত্র স্থান, এবং একে নিয়ে শত শত বছর ধরেই এ টানাপোড়েন চলছে। ইহুদিদের কাছে হারাম আল-শরিফ এলাকাটির নাম 'টেম্পল মাউন্ট' এবং এটিই তাদের ধর্মে সবচাইতে পবিত্র স্থান।


ইহুদিরা বিশ্বাস করে, এখানেই নবী আব্রাহাম তার পুত্র ইসমাইলকে উৎসর্গ করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। এখানেই ছিল ইহুদিদের প্রথম ও দ্বিতীয় পবিত্র মন্দির - যা ৭০ খ্রীষ্টাব্দে রোমান বাহিনী ধ্বংস করে দেয়। এখানে একটি খ্রীষ্টান ব্যাসিলিকাও ছিল যা একই সাথে ধ্বংস হয়।


সেই মন্দিরের শুধুমাত্র পশ্চিম দিকের দেয়ালটিই এখনো টিকে আছে, এবং এটিই এখন ইহুদিদের ধর্মীয় প্রার্থনার স্থান।


অন্যদিকে মুসলিমদের কাছে এটি 'হারাম আল-শরিফ' এবং ইসলাম ধর্মের তৃতীয় পবিত্র স্থান। প্রথম যুগের মুসলিমরা মক্কার আগে এর দিকে ফিরেই নামাজ পড়তেন ।


এখানে প্রথম ছোট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর, পরে ৭০৫ খ্রীষ্টাব্দে এখানে প্রথম বড় আকারে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।


দু'দফা ভুমিকম্পে দুবার ধ্বংস হয়ে গেলে তা পরে পুন:নির্মাণ করা হয়। এখন যে মসজিদটি আছে তা নির্মিত হয় ১০৩৫ সালে।


এর অনতিদূরেই আছে সোনালী গম্বুজবিশিষ্ট 'ডোম অব দি রক' বা 'কুব্বাত আল-শাখরা'। ইহুদিদের মন্দির ধ্বংস করে রোমানরা এখানে দেবতা জুপিটারের একটি মন্দির তৈরি করেছিল - যেখানে পরে ৬৮১ সালে উমাইয়া খলিফা আবদ-আল মালিকের সময় নির্মাণ করা হয় এই 'ডোম অব দি রক'।


ক্রুসেডাররা ১০৯৯ সালে এ জায়গাটি দখল করে নিলে তারা 'ডোম অব দি রক'কে একটি গির্জা হিসেবে এবং আল-আকসাকে রাজপ্রাসাদ, ঘোড়ার আস্তাবল ও নাইট টেম্পলারদের দফতর হিসেবে ব্যবহার করে।


আটকোণা এই ডোম অব দি রকের ভেতরেই রয়েছে সেই পাথরের ভিত্তি - যেখান থেকে ইসলামের নবী মুহাম্মদ মিরাজে গিয়েছিলেন বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন।


ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে জেরুসালেম ও পশ্চিমতীর দখল করে নেবার আগে এটি নিয়ন্ত্রণ করতো জর্ডন। এখন পূর্ব জেরুসালেম ইসরায়েল অধিকৃত। তবে আল-আকসা বা টেম্পল মাউন্ট এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করে একটি জর্ডনী-ফিলিস্তিনী ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান।


এখন ইসরায়েলিরা টেম্পল মাউন্ট এলাকায় যেতে পারে, কিন্তু এখানে তাদের প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ।


ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এখানে যে মেটাল ডিটেক্টর বসিয়েছে - এটিকে ফিলিস্তিনিরা এখানে ওয়াকফের কর্তৃত্বের লংঘন এবং ইসরায়েলি দখলদারির দৃষ্টান্ত বলে আখ্যায়িত করছেন।


তবে ইসরায়েল এটিকে একান্তই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখাতে চাইছে, কারণ মসজিদ এলাকাতেই এক সপ্তাহ আগে এক আক্রমণে দু'জন ইসরায়েলি পুলিশ নিহত হয়। কিন্তু এই আল-আকসা এলাকাটিতে ইসরায়েলি কর্মকান্ড প্রায় প্রতিবারই বিক্ষোভ-সহিংসতার জন্ম দিয়েছে।


আল-আকসায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের এক বিতর্কিত সফরকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় 'ইন্তিফাদা' বা গণঅভ্যুত্থান - যাতে ৪ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।


এ জায়গাটি এতই স্পর্শকাতর যে এখানে কোন সহিংস ঘটনা শেষ পর্যন্ত আরো একটি ইন্তিফাদা ডেকে আনবে কিনা - এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না।


পূর্ব জেরুসালেমের আরব অধ্যুষিত এলাকা শেখ জারাহ থেকে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে বাড়িছাড়া করার এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।


শেখ জারায় যে জমির ওপর ঐ চারটি ফিলিস্তিনি পরিবার গত প্রায় ৭০ বছর ধরে বসবাস করছেন - হঠাৎ তার মালিকানা দাবি করে কয়েকজন কট্টরপন্থী ইহুদি। জেরুসালেম নগর কর্তৃপক্ষ এবং শহরের একটি নিম্ন আদালত সেই দাবি মেনেও নেয়।


ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভের সূচনা সেখান থেকেই ,


বহুদিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধেছে যে ইসারায়েলি দক্ষিণপন্থীরা জেরুসালেম থেকে ছলেবলে তাদের উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর, এবং শেখ জারাহ থেকে ঐ চারটি পরিবারকে বাড়িছাড়া করার সিদ্ধান্ত সেই ছকেরই অংশ।


শেখ জারাহ এবং জেরুসালেমের পুরনো এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ফিলিস্তিনি কিশোর তরুণদের সাথে লেহাবা এবং আরো কিছু কট্টর ইহুদি সংগঠনের সদস্যদের সাথে বিচ্ছিন্নভাবে হাতাহাতি, গালিগালাজ বিনিময় চলছিল।


এরই মধ্যে রোজার শুরুতে পুলিশ জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের ওপর কিছু বিধিনিষেধ বসালে পরিস্থিতির আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে।


যেমন, বহুদিন ধরেই রোজার সময় পুরনো শহরের দামেস্ক গেটের চত্বরে সন্ধ্যায় জমা হয়ে ইফতার করে অনেক ফিলিস্তিনি। এবার ইসরায়েলি পুলিশ তা নিষিদ্ধ করে - যা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়। সেই সাথে যোগ হয় কট্টর ইহুদিদের ‘জেরুসালেম দিবস‘ কুচকাওয়াজ নিয়ে উত্তেজনা।


১৯৬৭ সালে আরবদের সাথে যুদ্ধে পূর্ব জেরুসালেম দখলের ঘটনাকে ইসরায়েলি দক্ষিণপন্থীরা প্রতিবছর উদযাপন করে। প্রতিবছর ১০ই মে এই উপলক্ষে কয়েক হাজার ইহুদি পূরব জেরুসালেমের ফিলিস্তিনি এলাকার ভেতরে দিয়ে মিছিল করে।


এবছর ঘটনাক্রমে দিনটি পড়েছে রোজার ভেতর। ফিলিস্তিনিরা চেয়েছিল এবার যেন ঐ মিছিলের রুট বদলানো হয়। কিন্তু ইসরায়েলি পুলিশ বা নগর কর্তৃপক্ষ তাতে কান দেয়নি যা নিয়ে ফিলিস্তিনিরা ক্ষুব্ধ ছিল । তবে সোমবার শেষ মুহূর্তের এক সিদ্ধান্তে মিছিলটি ফিলিস্তিনি এলাকায় যেতে দেওয়া হয়নি।


ইসরায়েলি রাজনীতির যোগসূত্র ,


সোমবার সকালে আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ইসরায়েলি পুলিশি অভিযান, তারপর সেই রাতেই ইসরায়েলকে লক্ষ্য গাযা থেকে রকেট ছোঁড়া এবং গাযায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর সংঘাত যে বিপজ্জনক চেহারা নিয়েছে - তা ২০১৮ সালের পর দেখা যায়নি।


সাংবাদিক হরিন্দর মিশ্র বলছেন, কয়েক বছর ধরে শান্তি আলোচনায় পুরোপুরি স্থবিরতা এবং কোভিড প্যানডেমিকের কারণে বহু মানুষ যে অর্থনৈতিক চাপে পড়েছেন সেটিও বহু মানুষের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা তৈরি করেছে যেটি, তার মতে, সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এই সংঘাতর পেছনে কাজ করছে বলে মনে করেন মি. মিশ্র।


গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলে একের পর এক নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছেনা। গত নির্বাচনের পরও বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু শরীক জোগাড় করে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট বিরোধী ইয়েস আডিট দলের নেতা ইয়ার লাপিডকে সরকার গঠনের সুযোগ দেন।


হরিন্দর মিশ্র বলেন, “সরকার গড়তে হলে আরব দলগুলোর সমর্থন দরকার মি. লাপিডের। সেই চেষ্টা তিনি করছিলেন। এখন জেরুসালেমের ঘটনাপ্রবাহ, ফিলিস্তিনি পরিবার উচ্ছেদের ঘটনায় আরব দলগুলো তো আর কথা বলতে চাইছে না। সোমবারের পর মি. লাপিড এবং তার বর্তমান শরিকদেরও এখন সরকার ও সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না“


ফলে, জোট সরকারের গঠনে মি. লাপিডের চেষ্টা ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। সুতরাং, হরিন্দর মিশ্র মনে করেন, চলতি এই সংঘাতের রাজনৈতিক ফায়দা এখন নিশ্চিতভাবেই পাবেন মি নেতানিয়াহু।


এখন পরিস্থিতির চাপে মি. লাপিড যদি জোট গঠনে ব্যর্থ হন, তাহলে ইসরায়েলে আরেক দফা নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে চলতি এই বিরোধ হয়তো সেই নির্বাচনে মি নেতানিয়াহুকে সাহায্য করতে পারে।সুত্র,বিবিসি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ